দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ কোনো না কোনো ক্যানসারে আক্রান্ত হন। বর্তমানে ৬০ হাজার ক্যানসার রোগী চিকিৎসার আওতায় আছেন। চাহিদার ৮০ শতাংশ ক্যানসারের ওষুধ দেশে তৈরি হয়। তবে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য আছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ক্যানসার নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো ‘ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’ সামনে রেখে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

শুরুতে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির পরিচালক অধ্যাপক এম এ হাই বলেন, গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল—সব ক্ষেত্রে ক্যানসার চিকিৎসায় বৈষম্য আছে। বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোল কাউন্সিলের অস্তিত্ব আছে শুধু কাগজ-কলমে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াররফ হোসেন বলেন, একসময় চিকিৎসকেরা নিজেদের চেম্বারে ক্যানসার রোগীকে কেমোথেরাপি দিতেন। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেক রোগী বমি করতেন। এ অবস্থা দেখে অপেক্ষমাণ অনেক রোগী ভয়ে পালাতেন। পরিস্থিতি পাল্টেছে।

অধ্যাপক মোয়াররফ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে এমন ১৬০টি কেন্দ্র লাগে। কিন্তু দেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র ২২টি।

দেশে স্তন ক্যানসার হু হু করে বাড়ছে উল্লেখ করে মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক পারভীন শাহিদা আখতার বলেন, ৬০-৭০ শতাংশ ক্যানসার রোগীর রেডিও থেরাপির দরকার হয়। কিন্তু যৎসামান্য রোগী এই চিকিৎসার সুযোগ পান। তিনি বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান বাড়িয়ে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব না। ক্যানসার প্রতিরোধে আমাদের জোর দিতে হবে।’

একাধিক আলোচক বলেন, ক্যানসার জটিল রোগ, এর চিকিৎসা খুব সহজ নয়। এটি একক চিকিৎসকের বিষয় নয়। দরকার দলগত প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য অনকোলজিস্ট, রেডিও অকনোলজিস্ট, প্যাথোলজিস্ট, সার্জনসহ নানা ধরনের বিশেষজ্ঞ নিয়ে চিকিৎসকদের একটি দল গঠন করতে হয়। এতে চিকিৎসা ভালো হয়। চিকিৎসা নির্ভুল করতে করপোরেট হাসপাতালগুলোতে এখন বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। এর নাম ‘টিউমার বোর্ড’। ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয়, এমন সব হাসপাতালে টিউমার বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই—একাধিক আলোচক এমন মন্তব্য করেন। বেসরকারি বিআরবি হাসপাতালের চিফ কনসালট্যান্ট (মেডিকেল অনকোলজি) অধ্যাপক মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া অনেকের মেনিয়ায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সুবিধা যা আছে, তার বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া দরকার।

আগের তুলনায় দেশে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসার পরিধি বেড়েছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, এমন নয়। এ প্রসঙ্গে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট অধ্যাপক এহতেশামুল হক বলেন, বায়োপসি ছাড়া অস্ত্রোপচার করা ঠিক নয়। কিন্তু অনেক অস্ত্রোপচার হচ্ছে বায়োপসি ছাড়াই।

একাধিক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের চেয়ে প্রতিবেশী দেশে ক্যানসারের ওষুধের দাম কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক এম এ খান বলেন, ‘সব ধরনের রক্ত ক্যানসারের চিকিৎসা বাংলাদেশে আছে। আমি অনুরোধ করব, চিকিৎসার জন্য কেউ যেন বিদেশে না যান।’

এম এ খান বলেন, দেশে রক্ত ক্যানসারের ১৭০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম বোনম্যারো প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছিল। এখন এভারকেয়ার হাসপাতাল, আসগর আলী হাসপাতাল ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই চিকিৎসা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এই চিকিৎসা চালুর চেষ্টা করছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আলীয়া শাহনাজ বলেন, ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে আসা ক্যানসার রোগীদের ১১ শতাংশ জরায়ু ক্যানসারের রোগী। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, ধূমপান, বহুগামিতা, দীর্ঘদিন জন্মনিরোধক বড়ি সেবন, বাল্যবিবাহ ও অপরিষ্কার থাকা জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি বলেন, সামাজিক বিধিনিষেধ বা চর্চা (সোশ্যাল ট্যাবু) ক্যানসার চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও অনেকে চিকিৎসা করেন না: কিছুটা ভয়ে, কিছুটা লজ্জায়। তিনিসহ আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

ক্যানসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় জাতীয় নীতি দরকার—এমন মন্তব্য করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ক্যানসার শনাক্তকরণ ব্যবস্থা ও জনবলের সংকট আছে। বিশেষজ্ঞ না হয়েও অনেকে ব্যবস্থাপত্রে ক্যানসারের ওষুধ লিখছেন। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ফেরদৌস শাহরিয়ার সাইদ বলেন, ক্যানসার নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা কম। মান নির্ণয় বা মানদণ্ড ঠিক করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দেশের ক্যানসার চিকিৎসার মান নিয়ে কথা বলা এবং বিদেশের সঙ্গে তুলনা করা মুশকিল।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে কথা বলেন এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম আনোয়ারুল হক। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে ক্যানসার ওষুধের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসত বিদেশ থেকে। ৯ বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। এখন ১৪০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশই ক্যানসারের ওষুধ।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা শুরু করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আড়াই ঘণ্টার এই বৈঠকে সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।